কিভাবে বিদেশ থেকে বাংলাদেশে পণ্য আনা যায়?

A Complete Guide to Sourcing Products in Bangladesh

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশ বিশ্ব অর্থনীতিতে একটা দারুণ সম্ভামনাময় সদস্য হিসেবে উঠে এসেছে। এখানকার বাজার দ্রুত বাড়ছে, আর সেই সাথে তাল মিলিয়ে বাড়ছে লোকজনের চাহিদা। এই অবস্থায়, বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের জন্য বিদেশ থেকে পণ্য আনার ব্যাপারটা খুবই আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। 

এই আর্টিকেলে, আমরা আপনাকে বুঝিয়ে বলব কীভাবে বিদেশ থেকে বাংলাদেশের বাজারের জন্য পণ্য আনতে হয়। আপনাকে কিছু প্রফেশনাল পরামর্শ আর প্র্যাকটিক্যাল টিপস দেব যাতে আপনার পণ্য আনার পুরো প্রক্রিয়াটা সহজ ও লাভজনক হয়। তাহলে আর দেরি কিসের? চলুন শুরু করা যাক।

বাংলাদেশের বাজার বিশ্লেষণ

বিদেশ থেকে পণ্য আনার আগে, আপনাকে ভালোভাবে বুঝতে হবে দেশের বাজারের অবস্থা কেমন। বাংলাদেশের অর্থনীতি দারুণভাবে বাড়ছে। গত দশ বছরে জিডিপি প্রতি বছর গড়ে ৬.৫% বেড়েছে। এই অর্থনৈতিক উন্নতির ফলে মধ্যবিত্ত শ্রেণী বেড়েছে, তাদের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে, আর তারা এখন আরও ভালো মানের জিনিস কিনতে চায়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ২০২৩ সালের একটা রিপোর্ট অনুযায়ী, কিছু সেক্টরে দারুণ গ্রোথ হয়েছে, যেখানে বিদেশি পণ্যের চাহিদা বাড়তে পারে, যেমনঃ

  1. ইলেকট্রনিক্স আর হোম অ্যাপ্লায়েন্সে: বছরে ২০% গ্রোথ
  2. গাড়ির পার্টস আর অ্যাক্সেসরিজে: বছরে ১৫% গ্রোথ
  3. কসমেটিক্স আর পার্সোনাল কেয়ার প্রোডাক্টে: বছরে ১২% গ্রোথ
  4. স্পেশাল খাবার আর পানীয়তে: বছরে ১০% গ্রোথ

এই সংখ্যাগুলো দেখে বোঝা যায় যে, বিদেশ থেকে ভালো মানের পণ্য এনে দেশের বাজারে ছাড়তে পারলে ব্যবসার দারুণ সুযোগ রয়েছে।

বাংলাদেশের আমদানি নিয়ম-কানুন আর শুল্ক নীতি

বাজার বিদেশ থেকে পণ্য আনার আগে, বাংলাদেশের আমদানি নিয়ম-কানুন বোঝাটা খুবই জরুরি। এই ব্যাপারে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড(এনবিআর)দেখভাল করে। ওদের ওয়েবসাইটে অনেক তথ্য পাওয়া যায়। এমনকি একটা ক্যালকুলেটরও আছে যেটা দিয়ে আপনি আন্দাজ করতে পারবেন কোন প্রোডাক্টে কত শুল্ক লাগবে।

ধরেন, আপনি স্মার্টফোন আনতে চান। এর HS কোড হল 8527.21.00। ২০২৪ সালের হিসেবে, এতে ২০% আমদানি শুল্ক লাগে। তবে মনে রাখবেন, প্রোডাক্ট অনুযায়ী এই শুল্ক অনেক বদলাতে পারে। কিছু জনপ্রিয় প্রোডাক্টের শুল্কের হিসেব নিচে দেয়া হোল:

স্মার্টফোন:HS CodeImport Duty (%)
স্মার্টফোন:8527.21.0020%
ল্যাপটপ8471.30.005%
কসমেটিক্স3304.99.0025%
প্রসেসড ফুড2106.90.0015%

তবে এই রেটগুলো বদলাতে পারে, আর এছাড়াও অন্য ট্যাক্স লাগতে পারে। তাই আপনার প্রোডাক্টের জন্য একজন কাস্টমস ব্রোকারের সাথে কথা বলাটা সবচেয়ে ভালো হবে।

কীভাবে নির্ভরযোগ্য বিদেশি সাপ্লায়ার খুঁজবেন

এখন যেহেতু আপনি বাজারের চাহিদা আর আমদানি নিয়ম বুঝে গেছেন, এবার সময় এসেছে ভালো বিদেশি সাপ্লায়ার খোঁজার। এই কাজের জন্য সহজ কিছু কৌশল নিচে আলোচনা করা হোলঃ

  1. অনলাইন B2B প্ল্যাটফর্ম

এমন কিছু ওয়েবসাইট আছে যেখানে ক্রেতা আর বিক্রেতা একসাথে আসে। যেমন:

  • আলিবাবা: এটা দুনিয়ার সবচেয়ে বড় B2B প্ল্যাটফর্ম। Alibaba এখানে ২০ কোটিরও বেশি ব্যবহারকারী আছে।
  • গ্লোবাল সোর্সেস: এটা ইলেকট্রনিক্স, ফ্যাশন আর হোম Global Sources প্রোডাক্টে স্পেশালাইজড।
  • থমাসনেট: এটা মূলত শিল্প সামগ্রী নিয়ে কাজ করে। ThomasNet ম্যানুফ্যাকচারিং ইকুইপমেন্ট আমদানির এটা একটা নির্ভরযোগ্য উৎস।

পরামর্শঃ এই সাইটগুলো ব্যবহার করার সময় সাপ্লায়ারদের ভেরিফিকেশন সিস্টেম আর রিভিউগুলো দেখে নিন।

  1. আন্তর্জাতিক ট্রেড শো

বিদেশি ট্রেড শো-তে যাওয়াটা সরাসরি সাপ্লায়ারদের সাথে দেখা করা, প্রোডাক্ট স্যামপ্ল দেখার দারুন একটা সুযোগ করে দিতে পারে আপনাকে। কিছু বড় ট্রেড শো হল:

  • ক্যান্টন ফেয়ার (চীন): চীনের Canton Fair সবচেয়ে বড় ট্রেড ফেয়ার।
  • CES (আমেরিকা): এটা Consumer Electronics Show টেকনোলজি আর ইলেকট্রনিক্সের জন্য বিখ্যাত।
  • Ambiente (জার্মানি): Europe’s leading trade fair এটা হোম ডেকোর, গিফট আইটেম নিয়ে।

এই শোগুলোতে যাওয়া একটু খরচের ব্যাপার, কিন্তু এখান থেকে আপনি অনেক কন্টাক্ট পাবেন।

  1. ট্রেড অ্যাসোসিয়েশন আর চেম্বার অব কমার্স

বাংলাদেশ আর আপনার টার্গেট দেশের ট্রেড অ্যাসোসিয়েশন আর চেম্বার অব কমার্সের সাহায্য নিতে পারেন। এরা প্রায়ই ভালো সাপ্লায়ারদের তালিকা রাখে।

বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজBCIএর ওয়েবসাইটে অনেক দরকারি তথ্য পাওয়া যায়।

কীভাবে বিদেশি সাপ্লায়ারদের যাচাই করবেন

সাপ্লায়ার খুঁজে পাওয়ার পর, তাদের ভালোভাবে যাচাই করা খুবই জরুরি। এজন্য কিছু পদক্ষেপ নিতে পারেন:

  1. তাদের ব্যবসার লাইসেন্স আর সার্টিফিকেট চেয়ে নিন, আর সেগুলো যাচাই করে দেখুন।
  2. দেখুন তাদের কাছে কোন স্পেশাল সার্টিফিকেট আছে কিনা ISO 9001 (যেমন, কোয়ালিটি ম্যানেজমেন্টের জন্য
  3. তাদের বর্তমান কাস্টমারদের কাছ থেকে রেফারেন্স চান, বিশেষ করে বাংলাদেশ বা আশেপাশের দেশের কাস্টমারদের কাছ থেকে।
  4. অনলাইনে সার্চ করে তাদের ব্যাকগ্রাউন্ড চেক করুন।
  5. প্রোডাক্টের স্যাম্পল চেয়ে নিন, নিজে দেখে কোয়ালিটি চেক করুন।

মনে রাখবেন, এই চেকিংয়ে একটু সময় লাগলেও, এটা আপনাকে পরে অনেক ঝামেলা থেকে বাঁচাবে।

কীভাবে বিদেশি সাপ্লায়ারদের সাথে যোগাযোগ আর দরদাম করবেন

বিদেশি সাপ্লায়ারদের সাথে ভালো যোগাযোগ রাখাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যেহেতু তারা অন্য দেশের, তাই কিছু জিনিস মাথায় রাখুন:

  1. কথা বলার সময় পরিষ্কার আর সংক্ষিপ্ত থাকুন। এমন কথা বলবেন না যা ওদের কাছে বোঝা কঠিন হতে পারে।
  2. ওদের দেশের কালচার আর ব্যবসার রীতিনীতি সম্পর্কে জেনে নিন। এতে করে অজান্তে কোনো ভুল করবেন না।
  3. টাইম জোনের ব্যাপারটা মাথায় রাখুন যখন কল করার কথা বলবেন বা জবাব আশা করবেন।

দরদামের ব্যাপারে, আগে থেকে প্রস্তুতি নিয়ে যান। আপনার পছন্দের প্রোডাক্টের সাধারণ দাম কত, সেটা জেনে যান। আর ভাবুন কোন বিষয়গুলোতে আপনি একটু হেরফের করতে পারেন - যেমন অর্ডারের পরিমাণ, পেমেন্টের শর্ত, এককালীন চুক্তি ইত্যাদি। শুধু দামের কথা না ভেবে, প্রোডাক্টের মান, ডেলিভারির সময়, বিক্রয়-পরবর্তী সেবা - এসব বিষয়ও মাথায় রাখুন।

কীভাবে কোয়ালিটি কন্ট্রোল আর লজিস্টিকস হ্যান্ডেল করবেন

কোয়ালিটি কন্ট্রোল

বিদেশ থেকে পণ্য আনার সময় কোয়ালিটি নিশ্চিত করা একটু চ্যালেঞ্জিং, কিন্তু খুবই জরুরি। এজন্য কিছু পদক্ষেপ নিতে পারেন:

  1. চুক্তিতে প্রোডাক্টের স্পেসিফিকেশন আর কোয়ালিটি স্ট্যান্ডার্ড পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করুন।
  2. প্রোডাকশন শুরুর আগে স্যাম্পল চেয়ে নিন আর অ্যাপ্রুভ করুন।
  3. প্রোডাকশন চলাকালীন কোয়ালিটি চেক করুন, হয় নিজে গিয়ে, নাহয় কোনো থার্ড-পার্টি ইন্সপেকশন সার্ভিস দিয়ে।
  4. শিপমেন্টের আগে শেষবার কোয়ালিটি চেক করুন।

বড় বড় ম্যানুফ্যাকচারিং হাবগুলোতে কিছু নামকরা থার্ড-পার্টি ইন্সপেকশন কোম্পানি কাজ করে, যেমন SGS এবং Bureau Veritasএরা নিরপেক্ষভাবে কোয়ালিটি চেক করে দিতে পারে।

লজিস্টিকস

আন্তর্জাতিক সোর্সিংয়ের ক্ষেত্রে লজিস্টিকস আর শিপিং খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের কিছু কমন টার্ম আছে (Incoterms বলে), যেগুলো ক্রেতা-বিক্রেতার দায়িত্ব নির্ধারণ করে। কিছু গুরুত্বপূর্ণ টার্ম হল:

  • FOB (Free on Board): বিক্রেতা শুধু পণ্য জাহাজে তোলা পর্যন্ত দায়ী থাকে।
  • CIF (Cost, Insurance, and Freight): বিক্রেতা খরচ, বীমা, আর ফ্রেইট গন্তব্য পোর্ট পর্যন্ত দেয়, কিন্তু জাহাজে ওঠার পর ঝুঁকি ক্রেতার।
  • DDP (Delivered Duty Paid): বিক্রেতা সব খরচ, শুল্কসহ, ক্রেতার দেওয়া ঠিকানা পর্যন্ত বহন করে।

শিপিং

শিপিংয়ের ব্যাপারে, একজন ফ্রেইট ফরওয়ার্ডারের সাথে কাজ করা ভালো। তারা আন্তর্জাতিক লজিস্টিক্সের জটিলতা সামলাতে পারে। বাংলাদেশে কিছু নামকরা ফ্রেইট ফরওয়ার্ডার হল:

  • সিমার্ক লজিস্টিক্স
  • শাহ লজিস্টিক্স
  • ইউনিভার্সাল ফ্রেইট সিস্টেমস

এরা কাস্টমস ক্লিয়ারেন্স, ডকুমেন্টেশন, আর পোর্ট থেকে আপনার গন্তব্য পর্যন্ত ট্রান্সপোর্টেশন - সব ব্যবস্থা করে দিতে পারে।

পেমেন্ট আর ফাইন্যান্সিং 

আন্তর্জাতিক পেমেন্ট করার সময় নিরাপত্তা আর দক্ষতা দুটোই মাথায় রাখতে হবে। সাধারণত যেসব পেমেন্ট পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়:

  1. লেটার অব ক্রেডিট (LC): বাংলাদেশে খুব জনপ্রিয়। এতে ক্রেতা-বিক্রেতা দুজনেরই নিরাপত্তা থাকে কারণ ব্যাংক মাঝখানে থাকে। LCs provide security for both buyer and seller by involving banks as intermediaries.
  2. ওয়্যার ট্রান্সফার: বিশ্বস্ত সাপ্লায়ারদের সাথে দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভালো।
  3. এস্ক্রো সার্ভিস: একটা থার্ড-পার্টি সার্ভিস যারা টাকা ধরে রাখে যতক্ষণ না শর্তগুলো পূরণ হয়।

আমদানি ফাইন্যান্স করার জন্য কয়েকটা অপশন আছে:

  1. ইমপোর্ট ফাইন্যান্সিং: অনেক বাংলাদেশি ব্যাংক এই সুবিধা দেয়। যেমন, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড বাংলাদেশ ভালো সুদে আর নমনীয় শর্তে ইমপোর্ট লোন দেয়।
  2. ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল লোন: সাপ্লায়ারদের পেমেন্ট দেওয়া আর কাস্টমারদের কাছ থেকে পেমেন্ট পাওয়ার মধ্যের সময়ের জন্য এই লোন নেওয়া যায়।
  3. সরকারি সহায়তা: বাংলাদেশ ব্যাংক মাঝে মাঝে গুরুত্বপূর্ণ সেক্টরের আমদানিকারকদের জন্য বিশেষ ফাইন্যান্সিং স্কিম দেয়। ওদের ওয়েবসাইটে চেক করে দেখতে পারেন।

কিভাবে দীর্ঘমেয়াদি পার্টনারশিপ গড়বেন

সফল আন্তর্জাতিক সোর্সিং শুধু একটা-দুটো লেনদেন নিয়ে নয়, এটা সাপ্লায়ারদের সাথে দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্ক গড়ার ব্যাপার। এজন্য কিছু কৌশল নিচে আলোচনা করা হোলঃ

  1. আপনার সাপ্লায়ারের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখুন, এমনকি অর্ডার না থাকলেও।
  2. আপনার ব্যবসার লক্ষ্য আর বৃদ্ধির পরিকল্পনা সম্পর্কে ওদের জানান।
  3. সময়মতো পেমেন্ট করুন আর প্রতিশ্রুতি রক্ষা করুন।
  4. মাঝে মাঝে আপনার মুখ্য সাপ্লায়ারদের সাথে দেখা করুন, এতে ব্যক্তিগত সম্পর্ক মজবুত হবে।
  5. একসাথে নতুন প্রোডাক্ট ডেভেলপ করা বা নতুন মার্কেটে ঢোকার মতো পারস্পরিক ব্যবসা বৃদ্ধির সুযোগ খুঁজুন এবং তা নিয়ে আলোচনা করুন।

পরিশেষে

বাংলাদেশের বাজারের জন্য বিদেশ থেকে পণ্য আনা একটা দারুণ সুযোগ। আপনি যদি টার্গেট মার্কেট ভালো বোঝেন, সাবধানে সাপ্লায়ার বাছাই করেন, আর লজিস্টিক্স ও ফাইন্যান্সিয়াল দিকগুলো ভালোভাবে ম্যানেজ করেন, তাহলে এই ফিল্ডে আপনি সফল হতে পারবেন।

মনে রাখবেন, আন্তর্জাতিক সোর্সিং একটা চলমান শেখার প্রক্রিয়া। মার্কেট ট্রেন্ড, নিয়ম-কানুনের পরিবর্তন, নতুন সোর্সিং গন্তব্য - এসব ব্যাপারে আপডেটেড থাকুন। ইন্ডাস্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনে যোগ দিন, ট্রেড সেমিনারে যান। এতে করে আপনি নেটওয়ার্ক বাড়াতে পারবেন আর সেরা প্র্যাকটিস সম্পর্কে জানতে পারবেন।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।