বাংলাদেশে ঘরে বসে কী ধরনের রিমোট কাজ করা যায়?

What Type of Work from Home Jobs You Can Do from Bangladesh

সম্প্রতি বছরগুলোতে, বাংলাদেশের চাকরির ক্ষেত্রে বেশ পরিবর্তন এসেছে। ডিজিটাল প্রযুক্তির উন্নতি আর কাজের ধরন বদলে যাওয়ায়, ঘরে বসে কাজ করার (ওয়ার্ক ফ্রম হোম বা রিমোট জব) সুযোগ দিন দিন বেড়ে চলেছে। এই আর্টিকেলে আমরা বাংলাদেশে ঘরে বসে করার কাজের সুযোগগুলো নিয়ে আলোচনা করব। ওয়ার্ক ফ্রম হোম জবের ক্ষেত্রে কি ধরনের কাজ পাওয়া যায়, এই ধরনের কাজ করতে কি জানা দরকার, আর কীভাবে এই কাজগুলো পাওয়া যায়, সে সম্পর্কে বিস্তারিত এক লেখায় জানতে পারবেন।

বাংলাদেশে জনপ্রিয় ঘরে বসে কাজের ধরন

বাংলাদেশে নানা রকমের রিমোট কাজের সুযোগ আছে। চলুন দেখি কোন কোন ক্ষেত্রে এই সুযোগ বেশি:

১. তথ্যপ্রযুক্তি ও সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট

রিমোট কাজের ক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তি (আইটি) সেক্টর সবচেয়ে এগিয়ে আছে। সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার থেকে ওয়েব ডেভেলপার পর্যন্ত, টেক দক্ষ লোকের চাহিদা বাড়ছেই। অভিজ্ঞ আইটি পেশাদাররা বাংলাদেশে ঘরে বসে গড়ে ৫০,০০০ থেকে ১,৫০,০০০ টাকা পর্যন্ত মাসিক আয় করতে পারে। তবে এটা তাদের দক্ষতা আর প্রজেক্টের ধরন এবং জটিলতার উপর নির্ভর করে।

২. কন্টেন্ট রাইটিং ও এডিটিং

কন্টেন্ট তৈরি ও এডিট করা রিমোট ওয়ার্কারদের জন্য আরেকটি লাভজনক সেক্টর। এর মদ্ধ্যে রয়েছে ব্লগ পোস্ট লেখা, বি২বি রাইটিং, কপিরাইটিং, টেকনিক্যাল রাইটিং ইত্যাদি । বাংলাদেশের ফ্রিল্যান্স রাইটাররা সাধারণত প্রতি শব্দে ২-৫ টাকা আয় করে। অভিজ্ঞ রাইটাররা আরো বেশি রেট পেতে পারে।

৩. ডিজিটাল মার্কেটিং

ব্যবসাগুলো যতই ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের দিকে ঝুঁকছে, ততই ডিজিটাল মার্কেটিং এ দক্ষ লোকের চাহিদা বাড়ছে। ডিজিটাল মার্কেটিং এর মধ্যে পড়ে সোশ্যাল মিডিয়া ম্যানেজমেন্ট, এসইও, ইমেইল মার্কেটিং, ইত্যাদি। ডিজিটাল মার্কেটিং পেশাদাররা ঘরে বসে ৩০,০০০ থেকে ৮০,০০০ টাকা পর্যন্ত মাসিক আয় করতে পারে। তবে এটা তাদের দক্ষতা, অভিজ্ঞতা আর ক্লায়েন্টদের উপর নির্ভর করে।

৪. কাস্টমার সার্ভিস

অনেক কোম্পানি আজকাল তাদের কাস্টমার সার্ভিসের কাজ আউটসোর্স করে দিচ্ছে। এতে বাংলাদেশিরা রিমোট কাস্টমার সার্ভিস রিপ্রেজেন্টেটিভ হিসেবে কাজ করার সুযোগ পাচ্ছে। এই কাজে সাধারণত ২০,০০০ থেকে ৪০,০০০ টাকা পর্যন্ত মাসিক বেতন পাওয়া যায়। এছাড়াও পারফর্মেন্স বোনাসের মতো সুবিধাও থাকতে পারে।

৫. অনলাইন টিচিং ও টিউটোরিং

বিশ্বব্যাপী ই-লার্নিং মার্কেট বাড়ার সাথে সাথে অনলাইন শিক্ষক আর টিউটরের চাহিদাও বাড়ছে। সেজন্য, অনলাইন টিচিং ও টিউটরিং এখন একটা চাহিদাসম্পন্ন রিমোট জব। উদাহরণ হিসেবে, ইংরেজি ভাষার টিউটররা প্রতি ঘন্টায় প্রায় ৫০০ থেকে ১০০০ টাকা পর্যন্ত আয় করতে পারে। তবে এটা তাদের টিচিং যোগ্যতা আর কোন প্ল্যাটফর্মে শেখাচ্ছেন তার উপর নির্ভর করে।

৬. ভার্চুয়াল অ্যাসিস্ট্যান্স

ভার্চুয়াল অ্যাসিস্ট্যান্টরা সারা বিশ্বের ব্যবসায়ী আর উদ্যোক্তাদের অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সাপোর্ট দেন। কাজের মধ্যে শিডিউলিং থেকে ডাটা এন্ট্রি পর্যন্ত অনেক কিছুই থাকতে পারে। বাংলাদেশে ভার্চুয়াল অ্যাসিস্ট্যান্টরা সাধারণত মাসে ২৫,০০০ থেকে ৬০,০০০ টাকা আয় করেন। এটা নির্ভর করে তাদের দক্ষতা আর ক্লায়েন্টের চাহিদার ওপর।

বাংলাদেশে ওয়ার্ক ফ্রম হোম জব কোথায় পাওয়া যায়

ওয়ার্ক ফ্রম হোম জব পেতে হলে দরকার সুনির্দিষ্ট কৌশল আর পরিকল্পনা। নিচে এই বিষয়ে কিছু কার্যকর উপায় নিয়ে আলোচনা করা হলোঃ

অনলাইন জব প্ল্যাটফর্ম

আপওয়ার্ক, ফাইভার আর ফ্রিল্যান্সার ডটকম এর মতো ওয়েবসাইটগুলোতে অনেক রকমের ঘরে বসে করার কাজ পাওয়া যায়। এই প্ল্যাটফর্মগুলোতে হাজার হাজার জব লিস্টিং থাকে। এখানে নিজেকে আলাদা করে তুলে ধরতে হলে, আপনার স্কিল আর অভিজ্ঞতা ভালোভাবে তুলে ধরে একটা আকর্ষণীয় প্রোফাইল বানান। সম্ভব হলে প্রফেশনাল ফটো আর আপনার কাজের স্যাম্পলও যোগ করুন।

লোকাল জব বোর্ড

বিডিজবস ডটকম আর বিক্রয় ডটকম এর মতো লোকাল জব বোর্ডগুলো দেখতে ভুলবেন না। অনেক বাংলাদেশি কোম্পানি এখন রিমোট পজিশনে হায়ার করছে আর এই সাইটগুলোতে প্রায়ই এরকম সুযোগ লিস্ট করা থাকে। "রিমোট", "ওয়ার্ক ফ্রম হোম" বা "টেলিকমিউট" এর মতো কীওয়ার্ড দিয়ে জব অ্যালার্ট সেট করে রাখুন যাতে নতুন লিস্টিং এলে জানতে পারেন।

নেটওয়ার্কিং

চাকরি খোঁজার ক্ষেত্রে নেটওয়ার্কিং এখনও খুব কার্যকর। নেটওয়ার্কিং করার জন্য ভার্চুয়াল ইন্ডাস্ট্রি ইভেন্টে যোগ দিন, লিংকডইনে প্রফেশনাল গ্রুপে জয়েন করুন, আর আপনার ফিল্ডের সাথে সম্পর্কিত অনলাইন ফোরামে অংশ নিন। অনেক রিমোট জবের সুযোগ পাবলিকলি বিজ্ঞাপন দেওয়ার আগেই পার্সোনাল কানেকশনের মাধ্যমে পূরণ হয়ে যায়। সেজন্য পার্সোনাল নেটওয়ার্কিং এর উপর জোর দিন।

অনলাইনে নিজের পরিচয় গড়ে তোলা

ডিজিটাল যুগে, আপনার অনলাইন উপস্থিতি হতে পারে আপনার সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ। লিংকডইন প্রোফাইল আপডেটেড রাখুন, নিজের পোর্টফোলিও দেখানোর জন্য একটা পার্সোনাল ওয়েবসাইট বানান, আর আপনার ইন্ডাস্ট্রি সম্পর্কে একটা ব্লগ শুরু করতে পারেন। এতে করে শুধু যে আপনার দক্ষতা প্রমাণ হবে তা-ই নয়, সম্ভাব্য নিয়োগকর্তারাও আপনাকে সহজে খুঁজে পাবেন।

রিমোট কাজে সফল হতে কি কি দক্ষতা লাগবে

টেকনিক্যাল স্কিল ছাড়াও, ঘরে বসে কাজ করার ক্ষেত্রে কিছু সফট স্কিলের প্রয়োজন হয়। নিচে এক্ষেত্রে কিছু গুরুত্বপূর্ন দক্ষতা তুলে ধরা হোলঃ

  1. টাইম ম্যানেজমেন্ট: ঘরে বসে কাজ করলে অনেক সময় ফ্লেক্সিবল সময়সূচি থাকে, তাই আত্মশৃঙ্খলা রক্ষা করা এক্ষেত্রে খুবই জরুরি। রেসকিউটাইম বা টোগল এর মতো টুল ব্যবহার করে আপনার প্রোডাক্টিভিটি ট্র্যাক করুন।
  2. কমিউনিকেশন: রিমোটে কাজ করার সময় ক্লিয়ার ও কমিউনিকেশন খুব গুরুত্বপূর্ণ। । স্ল্যাক, জুম আর ট্রেলোর মতো বিভিন্ন কমিউনিকেশন এবং প্রোডাক্টিভিটি টুল ব্যবহার করতে শিখুন।
  3. মোটিভেশান: যেহেতু রিমোট জবের ক্ষেত্রে ট্র্যাডিশনাল অফিসের কাঠামো নেই, আপনাকে নিজে থেকেই মোটিভেটেড থাকতে হবে। প্রতিদিন লক্ষ্য ঠিক করুন আর নিজের জন্য একটা রিওয়ার্ড সিস্টেম বানান যেনো নিজেকে মোটিভেটেড রাখতে পারবেন।
  4. নতুন জিনিস শেখার ক্ষমতা: রিমোট কাজের পরিবেশ দ্রুত বদলাতে পারে। নতুন টুল শেখার জন্য আর বিভিন্ন কাজের ধরনের সাথে মানিয়ে নেওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকুন।
  5. ডিজিটাল দক্ষতা: যেকোনো রিমোট কাজে বেসিক সফটওয়্যার ব্যবহার করতে পারা আর সমস্যা সমাধানের দক্ষতা আপনার কাজে আসবে। সেজন্য নিজের ডিজিটাল দক্ষতা বাড়ানোতে জোর দিন।

ঘরে বসে কাজের জন্য কার্যকর হোম অফিস কিভাবে বানাবেন

আপনার কাজের পরিবেশ আপনার প্রোডাক্টিভিটি আর জব স্যাটিসফ্যাকশনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। চলুন দেখি কিভাবে একটা কার্যকর হোম অফিস সেট আপ করা যায়।

শুরুতেই একটা নির্দিষ্ট হোম অফিস ডিজাইন করে নিন। কাজের জন্য একটা নির্দিষ্ট জায়গা বের করুন, এটা ঘরের একটা কোণাও হতে পারে। এতে করে কাজ আর ব্যক্তিগত জীবনের মধ্যে একটা মানসিক সীমারেখা তৈরি হয়।

শুধু একটা নির্দিষ্ট জায়গা থাকলেই সন্তোষজনক আর আরামদায়ক কাজের অভিজ্ঞতা নিশ্চিত হয় না। আপনার সেটআপ অবশ্যই এরগনোমিক হতে হবে। একটা আরামদায়ক চেয়ার আর সঠিক উচ্চতার ডেস্কে বিনিয়োগ করুন। বৈচিত্র্যের জন্য একটা স্ট্যান্ডিং ডেস্ক কনভার্টার কেনার কথা ভাবতে পারেন। চোখের উপর চাপ কমানোর জন্য কাজের যায়গায় পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা নিশ্চিত করুন।যদিও প্রাকৃতিক আলো সবচেয়ে ভালো, কিন্তু একটা ভালো ডেস্ক ল্যাম্প দিয়েও কাজ চালানো যেতে পারে।

সবশেষে, একটা খুব নির্ভরযোগ্য ইন্টারনেট কানেকশন নিন। আপনি যদি আপনার রিমোট জবকে একটা সিরিয়াস ক্যারিয়ারে পরিণত করতে চান তাহলে এটা একটা মাস্ট। বাংলাদেশে ঘন ঘন বিদ্যুৎ বিভ্রাট মোকাবেলা করার জন্য একটা ইউপিএস (আনইন্টারাপ্টিবল পাওয়ার সাপ্লাই) কেনার কথা বিবেচনা করতে পারেন।

বাংলাদেশে একটা বেসিক হোম অফিস সেট আপ করতে সাধারণত ২০,০০০ থেকে ৫০,০০০ টাকা খরচ হয়। এটা নির্ভর করে আসবাবপত্র আর যন্ত্রপাতির কোয়ালিটির ওপর।

শেষের কথা

যারা একটা ফ্লেক্সিবল ক্যারিয়ার গড়তে চান, তাদের জন্য ওয়ার্ক ফ্রম হোম একটা ভালো সুযোগ হতে পারে। এই নতুন ধরনের কাজের জগৎ সম্পর্কে ভালো ধারণা রাখা, প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জন করা, আর একটা কার্যকর কাজের পরিবেশ তৈরি করার মাধ্যমে আপনিও এই ক্ষেত্রে সফল হতে পারেন। মনে রাখবেন, রিমোট কাজে সাফল্য শুধু আপনার টেকনিক্যাল দক্ষতার ওপর নির্ভর করে না, বরং আপনার নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা, যোগাযোগের দক্ষতা, আর মোটিভেটেড থাকার ক্ষমতার ওপরও নির্ভর করে। যেহেতু বাংলাদেশ এই নতুন কাজের সংস্কৃতিকে গ্রহণ করছে, যারা এখন থেকে নিজেদের প্রস্তুত করবেন তারাই ভবিষ্যতের কর্মক্ষেত্রে এগিয়ে থাকবেন।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।