বাংলাদেশে ফ্রিল্যান্সার আইডি কার্ড কীভাবে পাবেন?

How to Get a Freelancer ID Card in Bangladesh

ফ্রিল্যান্সার আইডি কার্ডটা বাংলাদেশ সরকারের জাতীয় ফ্রিল্যান্সার রেজিস্ট্রেশন ও তথ্য কেন্দ্র (NFRIC) দেয়। এই সরকারি সংস্থা ফ্রিল্যান্সিং পেশাকে সাপোর্ট এবং নিয়ন্ত্রণ করে। এই কার্ডটা শুধু একটা পরিচয়পত্রই নয়, এটা নানান ধরনের সুবিধা পাওয়ার একটা মাধ্যম আর ফ্রিল্যান্স মার্কেটে পেশাদার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার একটা উপায়। আজকের এই লেখায় আমরা দেখব কীভাবে বাংলাদেশে ফ্রিল্যান্সার আইডি কার্ড পাওয়া যায়। চলুন শুরু করা যাক।

ফ্রিল্যান্সার আইডি কার্ডের জন্য কী কী যোগ্যতা লাগে?

ফ্রিল্যান্সার আইডি কার্ডের জন্য আবেদন করার আগে, আপনাকে জানতে হবে কি কি যোগ্যতার ভিত্তিতে আপনি আবেদন করতে পারবেন। যোগ্যতা নির্ধারণের কিছু সহজ শর্ত রয়েছে:

  1. নাগরিকত্ব: আপনাকে অবশ্যই বাংলাদেশের নাগরিক হতে হবে এবং একটি বৈধ ন্যাশনাল আইডি কার্ড (এনআইডি) থাকতে হবে।
  2. বয়স: আপনার বয়স কমপক্ষে ১৮ বছর হতে হবে।
  3. আয়: গত ১২ মাসে অনলাইন কাজের মাধ্যমে কমপক্ষে $১,০০০ আয় করতে হবে।
  4. আয়ের উৎস: আয় অবশ্যই বিদেশী উৎস থেকে আসতে হবে।
  5. কাজের প্রমাণ: ফ্রিল্যান্স মার্কেটপ্লেস বা সরাসরি ক্লায়েন্টদের কাছ থেকে প্রাপ্ত চুক্তি বা কাজের প্রমাণ দিতে হবে।
  6. আইনসিদ্ধ: আপনার আয়টা সেবা প্রদান বা ডিজিটাল প্রোডাক্ট বিক্রি করে আইনসিদ্ধ পদ্ধতিতে আসতে হবে।

এই শর্তগুলোর মধ্যে কোনো একটি পূরণ করতে ব্যর্থ হলে আপনার আবেদন বাতিল হতে পারে।

আবেদনকারীদের ধরণ

ফ্রিল্যান্সার আইডি সিস্টেমে তিন ধরণের ফ্রিল্যান্সার আবেদনকারীকে স্বীকৃতি দেয়া হয়:

  1. ইন্ডিভিজুয়াল ফ্রিল্যান্সার: একজন ফ্রিল্যান্সার বা অনলাইন কর্মী যে স্বাধীনভাবে কাজ করে।
  2. ফ্রিল্যান্সার টিম ওনার: এমন একজন ব্যক্তি যে ফ্রিল্যান্সারদের একটি ছোট টিম (সর্বোচ্চ ১৫ জন সদস্য) চালায়।
  3. ফ্রিল্যান্সার টিম মেম্বার: এমন একজন ব্যক্তি যে ফ্রিল্যান্স টিমের সদস্য। টিমের মেম্বাররা আবেদন করার আগে টিম ওনারের ফ্রিল্যান্সার আইডি অ্যাপ্রুভড থাকতে হবে।

ফ্রিল্যান্সার আইডি কার্ডের জন্য স্টেপ-বাই-স্টেপ আবেদন প্রক্রিয়া

১. অফিশিয়াল ওয়েবসাইটে রেজিস্ট্রেশন

ফ্রিল্যান্সার আইডি কার্ড পাওয়ার যাত্রা শুরু হবে অফিসিয়াল NFRIC ওয়েবসাইট থেকে: https://app.freelancers.gov.bd/এখানে আপনাকে নিচের জিনিসগুলো করতে হবে:

  1. ওয়েবসাইটটি ভিজিট করুন এবং নিবন্ধন অপশনটি খুঁজুন।
  2. আপনার নাম, ইমেইল ঠিকানা, এবং ফোন নম্বর সহ অন্যান্য মৌলিক তথ্য দিয়ে একটি অ্যাকাউন্ট তৈরি করুন।
  3. প্রদত্ত নির্দেশনা অনুযায়ী আপনার ইমেইল ঠিকানা বা ফোন নম্বর যাচাই করুন।

** মনে রাখবেন, এখানে সঠিক তথ্য দেওয়া খুব জরুরি। আপনি যে তথ্য দিবেন, সেটা যেন আপনার অফিশিয়াল ডকুমেন্টের সাথে মেলে। এতে করে ভেরিফিকেশন প্রক্রিয়ায় কোনো সমস্যা হবে না।**

২. ডকুমেন্ট জমা দেওয়া

আপনার আবেদন প্রক্রিয়ার সময় আপনাকে নিম্নলিখিত ডকুমেন্টগুলি জমা দিতে হতে পারে:

  • পেওনিয়ার বা অন্যান্য অনলাইন পেমেন্ট গেটওয়ে অ্যাকাউন্টের স্টেটমেন্ট
  • ফ্রিল্যান্সিং মার্কেটপ্লেসের অ্যাকাউন্ট স্টেটমেন্ট
  • ব্যাংক অ্যাকাউন্ট স্টেটমেন্ট
  • রেমিট্যান্স সার্টিফিকেট
  • আপনার ফ্রিল্যান্সিং আয়ের রেকর্ড দেখায় এমন অন্য যেকোনো ডকুমেন্ট

ডকুমেন্ট সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটা কথা:

  • এগুলোতে আবেদনকারীর গত ১২ মাসের আয় প্রতিফলিত হতে হবে।
  • ডকুমেন্টে আবেদনকারীর পরিচয় যেনো পরিস্কারভাবে দেখা যায়।
  • ডকুমেন্টগুলো বৈধভাবে অনুমোদিত হতে হবে।
  • লেনদেনের আইডি, তারিখ, শিরোনাম বা বিবরণ পরিস্কারভাবে দৃশ্যমান থাকতে হবে।

৩. আবেদন ফি জমা দেওয়া

আবেদন জমা দেওয়ার পর, আপনাকে ১৫০০ টাকা আবেদন ফি দিতে হবে। পেমেন্টের বিস্তারিত তথ্য আপনার ইমেইলে পাঠানো হবে। আপনার আবেদন বাতিল হলে, ২০% অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ফি বাদ দিয়ে বাকি টাকা ফেরত পাবেন।

৪. যাচাই প্রক্রিয়া

যাচাই প্রক্রিয়া ৭-৩০ দিন সময় নিতে পারে এবং এর মধ্যে থাকতে পারে:

  • ডকুমেন্ট অথেনটিকেশন
  • সম্ভাব্য ব্যাকগ্রাউন্ড চেক
  • কোনো কিছু স্পষ্ট করার জন্য বা অতিরিক্ত তথ্যের জন্য একজন অ্যাসেসর আপনার সাথে ইমেইল বা ভিডিও কলে যোগাযোগ করতে পারেন
  • ভিডিও কলের সময় কিছু জিনিস যাচাই করার জন্য আপনাকে আপনার কম্পিউটারের স্ক্রিন শেয়ার করতে বলা হতে পারে

৫. আইডি কার্ড ইস্যু করা

যাচাই প্রক্রিয়া সফলভাবে শেষ হলে, আপনাকে ইমেইল বা এসএমএস-এর মাধ্যমে জানানো হবে। তারপর আপনি www.freelancers.gov.bd পোর্টালে লগ ইন করে আপনার ভার্চুয়াল আইডি কার্ড দেখতে বা ডাউনলোড করতে পারবেন।

ভার্চুয়াল আইডি কার্ডে কি কি বিবরণ দেখানো হয়

ফ্রিল্যান্সার আইডি কার্ড পুরোপুরি ভার্চুয়াল এবং এতে থাকবে:

  • ফ্রিল্যান্সারের ছবি
  • নাম
  • দক্ষতা
  • FID নম্বর
  • ইস্যু বছর
  • ঠিকানা
  • জন্ম তারিখ
  • QR কোড যা ফ্রিল্যান্সারের আইডি প্রোফাইলের সাথে সংযুক্ত

ফ্রিল্যান্সার আইডি প্রোফাইলে আবেদনের সময় জমা দেওয়া সব যাচাইকৃত তথ্য থাকে। এই প্রোফাইল শুধুমাত্র ফ্রিল্যান্সার পোর্টালে লগ ইন করে দেখা যায় অথবা কিউআর কোড স্ক্যান করে এবং আবেদনকারীর ফোনে পাঠানো ওটিপি দিয়ে দেখা যায়।

ফ্রিল্যান্স আইডি কার্ডের মেয়াদ কত দিন এবং এটি কীভাবে নবায়ন করবেন?

ফ্রিল্যান্সার আইডি কার্ডের মেয়াদ ১২ মাস। এই সময়ের মধ্যে আপনি কার্ডের তথ্য (যেমন, আয়ের বিবরণ) আপডেট করতে পারবেন, তবে যেকোনো আপডেট রিকোয়েস্টকে নতুন আবেদন হিসেবে গণ্য করা হয় এবং একই প্রসেসিং ফি লাগে।

১২ মাস পর, আপনাকে আপনার তথ্য আপডেট করার জন্য অনুরোধ করা হবে। এই নবায়ন প্রক্রিয়াকেও নতুন আবেদন হিসেবে ধরা হয় এবং একই যাচাই প্রক্রিয়া ও ফি কাঠামো অনুসরণ করা হয়।

ফ্রিল্যান্সার আইডি কার্ড থাকলে কী কী সুবিধা পাওয়া যায়?

ফ্রিল্যান্সার আইডি কার্ডের প্রধান সুবিধা হলো সরকারিভাবে স্বীকৃতি পাওয়া। এটি আপনার ফ্রিল্যান্সার স্ট্যাটাসের প্রমাণ হিসেবে কাজ করে। এছাড়া, বিভিন্ন আবেদন এবং সেবায়, যেখানে কর্মসংস্থান এবং আয়ের প্রমাণ দিতে হয়, সেখানে এটি কাজে লাগতে পারে। 

আপনি এটি ব্যবহার করে বিভিন্ন ব্যাংকিং সেবা যেমন অ্যাকাউন্ট খোলা বা লোন নেওয়ার জন্য আবেদন করতে পারবেন। এবং ভবিষ্যতে যদি বাংলাদেশ সরকার ফ্রিল্যান্সারদের জন্য কোনো সুবিধা ঘোষণা করে, তাহলে বৈধ ফ্রিল্যান্সার আইডি কার্ড থাকলে আপনি সেই সুবিধা পাওয়ার যোগ্য হবেন। 

গোপনীয়তা ও তথ্য সুরক্ষা

এই আইডি কার্ড সিস্টেমে আপনার গোপনীয়তাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়, আর কে আপনার তথ্য দেখতে পারবে সেটা আপনি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। নিম্নলিখিত সংস্থাগুলো নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে আপনার তথ্য দেখতে পারে:

  1. আপনি (ফ্রিল্যান্সার)
  2. তৃতীয় পক্ষের সংস্থা (ব্যাংক, ইন্স্যুরেন্স প্রোভাইডার) শুধুমাত্র আপনার অনুমতি নিয়ে, ওটিপির মাধ্যমে
  3. সরকারি সংস্থা, নিরাপত্তা ও সমীক্ষার উদ্দেশ্যে (লিখিত অনুরোধের ভিত্তিতে)
  4. আবেদন প্রক্রিয়াকারী, আপনার প্রদত্ত তথ্যের সত্যতা যাচাইয়ের জন্য

সাধারণ জিজ্ঞাসা 

আপওয়ার্ক বা ফাইভারের মতো প্ল্যাটফর্মে কাজ না করলেও কি আমি ফ্রিল্যান্সার আইডি পেতে পারি? 

হ্যাঁ, যদি আপনার ভার্চুয়াল কাজ বা সেবা থেকে বিদেশি সূত্র থেকে যাচাইযোগ্য আয় থাকে।

ফ্রিল্যান্সার আইডি কার্ড ব্যাংক লোন বা ক্রেডিট কার্ড পাওয়ার নিশ্চয়তা দেয় কি? 

না, তবে এটি কর্মসংস্থান এবং আয়ের প্রমাণ হিসেবে কাজ করে। ব্যাংকগুলো তাদের নিজস্ব যথাযথ যাচাই-বাছাই করবে।

কি কোনো ফিজিক্যাল আইডি কার্ডের অপশন আছে? 

না, বর্তমানে শুধু ভার্চুয়াল আইডি কার্ডই দেওয়া হচ্ছে।

কোনো ব্যাংক যদি আমার ফ্রিল্যান্সার আইডি গ্রহণ না করে তাহলে কী করব? 

[email protected]তে যোগাযোগ করে ব্যাংকের সাথে সমস্যা সমাধানে সহায়তা চাইতে পারেন।

ফ্রিল্যান্সার আইডি কি ট্যাক্স ফাঁদ? 

না। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মতে, ৩০ জুন ২০২৪ পর্যন্ত তথ্য প্রযুক্তি নির্ভর সেবা (আইটিইএস) থেকে আয় কর মুক্ত।

সারসংক্ষেপ

ফ্রিল্যান্সার আইডি কার্ড বাংলাদেশের ফ্রিল্যান্স অর্থনীতিকে স্বীকৃতি দেওয়া ও সমর্থন করার ক্ষেত্রে একটা গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এটি আপনাকে একজন ফ্রিল্যান্সার হিসেবে সরকারিভাবে স্বীকৃতি প্রদান করে, বিভিন্ন প্রশাসনিক প্রক্রিয়াকে সহজ করে এবং আপনাকে ডিজিটাল অর্থনীতিতে একজন স্বীকৃত পেশাদার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।

বাংলাদেশের ফ্রিল্যান্সারদের জন্য এই আইডি কার্ড পাওয়াটা প্রফেশনাল ফিউচারের জন্য একটা মূল্যবান বিনিয়োগ। এটা শুধু আপনার ফ্রিল্যান্সার পরিচিতিকে স্বীকৃতিই দেয়না, বরং বিভিন্ন সুযোগ ও সম্ভাবনার দরজাও খুলে দেয়।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।